এক মায়ের গল্প, গল্পের নাম “মা কেবলই মা”


মেয়েকে কোলে নিয়ে ক্লাস নিচ্ছেন—এমন একটি ছবি নিজের ফেসবুকে পোস্ট করে ডানা লিখেছেন, ‘মা কেবল মা, এর তুলনা অন্য কিছুর সাথে হয় না। তাঁর এই পোস্ট নিয়ে ফেসবুকে বেশ আলোচনা হয়। সন্তানের জন্য মায়েরা কীভাবে যেকোনো পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন, তা তুলে ধরার চেষ্টা করেন অনেকে। ডানা ত্রিপুরার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন তাঁরা। তিনি ছাত্র ছাত্রীদের যেমন পাঠদান করেন তেমনি সন্তান দের যত্ন করে যাচ্ছেন সমান তালে।
এরপর বিষয়টি নিয়ে মঙ্গলবার ফোনে কথা হয় ডানার সাথে। ত্রিপুরা বলেন, ‘কোনো কিছু ভেবে ছবি পোস্ট করিনি। আমরা মায়েরা বাচ্চা পালতে পারি, একইভাবে পেশাগত দায়িত্বও পালন করতে পারি। আর পাহাড়ে জন্ম যে নারীদের, তাঁরা বাচ্চা কোলে নিয়ে এর চেয়েও কঠিন কঠিন ও ভাড়ীও কাজ করতে পারেন। আমাকে আমার স্কুলের প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে অন্য শিক্ষকেরাও সার্বিক সহায়তা করছেন। অন্য নারী শিক্ষকেরাও প্রয়োজন হলে বাচ্চাকে সঙ্গে আনেন। তবে এত ছোট বাচ্চা এখন আমারই আছে।’
আমি সুন্দর ভাবে আমার কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আমার পেশা ও মায়ের দায়িত্ব পালনে কোন প্রকার অসুবিধা হচ্ছে না। দুইটি কাজ ই আমার অনেক পছন্দের।
ডানা জানালেন, তাঁর বাসা থেকে স্কুলের দূরত্ব হাঁটাপথে ৪-৫ মিনিট লাগে। বাসায় মেয়েকে দেখভাল করবেন তেমন কেউ নেই। দীর্ঘ সময়, তাই সন্তানের নিরাপত্তার কথাও ভাবতে হয়। ব্যবসায়ী স্বামী একসঙ্গে দুই মেয়েকে সামলাতে পারেন না। তাই হয় বড়, না হয় ছোট মেয়—একজনকে সঙ্গে রাখতেই হয় আমার। এছাড়াও আম্র ছোট মেয়েটি বুকের দুধ পান করে, তাই তাকে সঙ্গে আমার রাখতেই হয়।এলাকায় শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র থাকলে তাঁর মতো কর্মজীবী নারীদের সুবিধা হতো বলে মনে করেন ডানা। আমার কলিগরা আমাকে অনেক সাহায্য করে , তাদের কারণে ই আমি সুন্দর ভাবে আমার কাজটি সমাধা করতে পারছি।

২০১৫ সালে বিয়ে করেন ডানা ত্রিপুরা। তিনি এসএসসি পাস করেছেন কক্সবাজারের রামু থেকে। এরপর রাজধানীর এমসিইটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং (আর্কিটেকচার) করেছেন। এরপর গত ৯ বছর ধরে স্কুলটিতে শিক্ষকতা করছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি স্বামীর পাহাড়ি মধু ব্যবসা উদ্যোগে সহায়তা করছেন। কেন্দ্রবিন্দু নামের একটি সংগঠনের তাঁতিদের বানানো বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করেন। কল্পপুরী স্কুল অব আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফটসে দৃশ্যকলা বিভাগের সহকারী শিক্ষক হিসেবে শুক্রবার ক্লাস নেন।
ডানা জানালেন, বড় মেয়ে যখন ছোট ছিল, সে সময় তাঁর কাজ করতে তেমন সমস্যা হয়নি। তখন তিনি তাঁর মা–বাবার সঙ্গে থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন। এখন আলাদা বাসায় থাকেন। তাঁর মা–ও কর্মজীবী নারী। মা, ননদ বা বাসায় বাচ্চাদের দেখার মতো কেউ থাকলে তখন বাচ্চাদের বাসায় রেখেই কাজের সুযোগ পান ডানা।
মেয়েকে নিয়ে স্কুলে গেলে কাজের কোনো ব্যাঘাত ঘটে কি না, জানতে চাইলে হাসতে হাসতে ডানা বললেন, ‘বেশির ভাগ সময়ই মেয়ের সারা দিনের খাবারসহ গাট্টি–বোঁচকা বেঁধে রওনা দিতে হয়। বাচ্চা, তাই সব সময় চুপ করে তো আর থাকে না। বেশি বিরক্ত করলে ক্লাসের বাচ্চাদের কাছ থেকে মাঝেমধ্যে একটু সময় চেয়ে নিয়ে বাচ্চাকে সামলানোর চেষ্টা করি। বাসায় কেউ থাকলে তাঁকে এসে নিয়ে যেতে বলি।’
করোনার সময় শিক্ষার্থীদের স্কুল বন্ধ থাকলেও শিক্ষকদের নানা কাজে স্কুলে যেতে হয়েছে। তখনো মেয়েকে সঙ্গে নিয়েই স্কুলে গেছেন ডানা। ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১ থেকে ক্লাস শুরু হয়েছে। মেয়েদের নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ডানা বললেন, ‘আমি যখন সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা, তখন বড় মেয়েকে হাতে ধরে স্কুলের শিশু জরিপের কাজও করেছি। পেশাগত দায়িত্ব পালনে কখনো অবহেলা করিনি। তবে যেহেতু আমি মা, তাই সব সময় আমার মেয়েদের নিরাপত্তার বিষয়টি অগ্রাধিকার পায়।’
জিয়াউল হক বললেন, বাচ্চা নিয়ে ক্লাসে গেলে অন্য বাচ্চাদের মনোযোগ নষ্ট হতে পারে। তাই ডানা ত্রিপুরাকে পরামর্শ দিয়েছেন, ক্লাসের সময় খুব বেশি প্রয়োজন না হলে সে সময় যে শিক্ষকের ক্লাস থাকবে না, তাঁর কাছে যাতে রেখে আসেন।
এই প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘মেয়েটির বয়স অন্তত এক বছর না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সহায়তা করতেই হবে।’ সে মা বাচ্চার নিরাপত্তাও তাকে দেখতে হবে।
ডানা ত্রিপুরা গত বছর মধু ব্যবসার উদ্যোগ নিয়ে ফেসবুকে ১২ লাখের বেশি সদস্যের প্ল্যাটফর্ম উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরামের (উই) সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। উইয়ের সভাপতি নাসিমা আক্তার (নিশা) বলেন, ‘ছবিটাই বলে দিচ্ছে, মা মানেই মা। তিনি মায়ের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি স্বপ্ন পূরণের কাজও করে যাচ্ছেন। তবে সন্তানের বেলায় কোনো ছাড় দিচ্ছেন না। ভাবা হয়, সন্তানের জন্মের পর নারীদের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায়, এই নারীর ক্ষেত্রে তা হয়নি। পরিবার ও কর্মক্ষেত্রের সহায়তা পাচ্ছেন বলেই তিনি সব সামলাতে পারছেন। বান্দরবান থেকে অনলাইনে তিনি উইয়ের বিভিন্ন কোর্স, প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি ব্যবসায়ী হতে গেলে যা যা প্রয়োজন, তাতে উই সার্বিকভাবে সহায়তা করছে।’
ডানার ছবি এখন ভাইরাল সকল নারীরা তাকে শুভ কামনা জানিয়েছেন, এবং তার ও বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ যাতে উজ্জ্বল হয় সেই আশির্বাদ করেছেন।